গর্বের মধু গড়মিল

গর্ব (অক্টোবর ২০১১)

এফ, আই , জুয়েল
  • ৬৬
রুপবতী উঠোনে রুপের বিচিত্র বাহার । ঘন যৌবনের দুষ্টামী ভরা আধাপাঁকা বুদ্ধি আর আবেগের দোলায়----, মাতবে সবাই । ত্রিশ তম জন্ম তিথীতে প্রতি বছরের মত মহা ধুমধামে মজমা জমবে । মৌজ হবে । সাকী ,শরাব আর নূপুরের নিক্কনে রাতের রাণী অহংকারে উতালা হবে । তাকে ঘিরে উত্সব চলবে । মানুষ রুপী কতশত বিলাসী ভ্রমরের গুনগুন গুঞ্জন তার মনে নব- তরঙ্গের সৃস্টি করবে । তার অন্তরের হাহাকার মনের মানুষ পাবার আশায় হু-হু করে উঠবে । যদি আশা পূরন না হয় , তাহলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভোর হবার আগেই সে চলে যাবে । আবার অপেক্ষায় থাকবে পরের বছরের জন্য ।

রাতের প্রথম প্রহর চলে গেছে । বন্ধু-প্রিয়-আত্মীয় সহ অনেকেই এসে গেছে । আর দেরী নাই । প্রথমে নাচের তালে তালে একটা গান হবে । এরপর শুভেচ্ছা বিনিময় । তারপর মূলপর্ব । পর্বের পরতে পরতে বাড়তে থাকবে রাণীমাতার গর্বের উল্লাস ।

রাণীমাতার কালো অঙ্গে যেন রুপের নাচন । এইজন্য অনেকেই তাকে কালো পরী বলে ডাকে । আবার বয়সের চেয়ে জ্ঞানের মাত্রাটা বেশী হওয়ায় ভক্তদের কাছে সে জ্ঞানো-পরী নামে বেশী পরিচিত । জ্ঞান, সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্বের প্রভাব তাকে রাণী মাতার আসনে বসিয়ে দিলেও---, তার রয়েছে একটু বাড়াবাড়ি রকমের- হালকা অহংকার ।

রুপবতী উঠোনের রাতের জলসায় যাবার জন্য অনেকদিন থেকেই শীলাদেবী আমাকে তাগাদা দিয়ে আসছে । সেখানে যেয়ে সুযোগ বুঝে রাণী মাতাকে love you বলতে হবে । কিন্তু এর পরের অবস্থা কিভাবে সামাল দেয়া যাবে ? এ সম্পর্কে শীলাদেবী একেবারেই নিশ্চুপ । কারণ সেটা তার জ্ঞানের বাইরে----- । নিরুপায় হয়ে সে আমাকে নিয়ে যায় মিথ্যা মহলে , গুরুরাজ আজরাহার কাছে ।

এই মিথ্যা মহল এক বিস্ময়কর চমক লাগানো স্থান । এখানে ধ্যানের সাথে চলে সত্যের নাচন । এখানে খুব উচ্চ পর্যায়ের সবক দেয়া হয় । আত্মার জ্ঞানের সাথে বুদ্ধির জ্ঞানের সংযোগ ঘটিয়ে , 'মহাকাল আর মহাবিশ্ব' ভ্রমনের ইঙ্গিত দেয়া হয় । গুরুরাজ আজরাহা খুব উঁচু মানের সাধক পুরুষ । তার সান্নিধ্য পাওয়া পরম ভাগ্যের ব্যপার ।

এই মহলে সবাই খাদেম । এখানে ভক্তরা মিথ্যা ও বিভ্রান্তি নিয়ে আসে আর সত্য নিয়ে বেরিয়ে যায় । সত্যকে চেনা এবং সত্য ধারনের ক্ষমতা যাদের অর্জিত হয়--, শুধু তারাই গুরুরাজের জ্ঞানের জলসার অতিথী হতে পারে ।

এই মিথ্যা মহলে প্রবেশের বাসনায় শীলা দেবীর পিছনে কতই-না ঘুর ঘুর করেছি । এখন অবশ্য তার আত্মার সাথে অনেকটা একাত্ম হয়ে গেছি । লোক-লজ্জার ভয় আর সামাজিক ভ্রূক্রুটি উপেক্ষা করে সময়ে অ-সময়ে শীলা দেবী যখনি ডেকেছে---, তখনই ছুটে গেছি তার কাছে । কত না রাত কেটেছে একান্তে , নির্জনে---শ্মশানে , কবরস্থানে , নদীর ধারে , ঝরনা তীরে । আর হূদয়ের গভীর হতে উথলে উঠা আনন্দের হিল্লোলে হেসেছি কতনা মধুর হাসি । সমাজের কিছু লোক শুধু করেছে ছিঃ ছিঃ । শীলা দেবী শুধু তাকে বুঝে অনুসরণ করার তাগিদ দিত । সমাজের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর অপমানের জবাব দিতে নিষেধ করত । এ গুলোর সাথে জড়িয়ে পরলে ধ্যানের পথে চলা কঠিন হয়ে যাবে । সামাজিক চাপ অসহ্য মনে হলে , শুধু এইটুকু বলার অনুমতি ছিল----
" দৃষ্টি দোষে দেখছ বাঁকা , আমার সরল পথটাকে /
সবার আগে ভালো কর, ঝাঁপসা তোমার চোখটাকে // "

মিথ্যা মহলের দরবার হল পেরিয়ে আজরাহা গুরুর সাথে দেখা হলো , কথা হলো । সে এক অন্যরকম অনুভূতির মধ্য দিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো । দরবার হলে অনেক বই । অনেক লোকের সমাগম । অথচ সেখানে অসম্ভব রকমের নিরবতা বিরাজমান ।

জ্ঞানো-পরী বা রাণীমাতা কয়েক বছর ধরে মনের মানুষ খুঁজছে । এর জন্য প্রতি বছর বিশেষ দিনে সে জলসার আয়োজন করে । মনের মানুষ সে পেতে পেতেই পায় না । যাদেরকে মনে লাগে---- , তাদেরকে জ্ঞানের ছোঁয়ায় পরখ করে নিতে চায় । এই জ্ঞানের বাহাদুরীই রাণী মাতাকে বড় বেশী দিশেহারা করে দিয়েছে ।
রুপবতী উঠোনের জলসা রাতের প্রতিটি মূহুর্ত ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায় । সেখানে একের পর এক ভিন্ন রকম পরিবেশ ও পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে থাকে ।
যদিও মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম 'হোমোসেপিয়েন্স' বা আমরাই বুদ্ধিমান । কিন্তু বুদ্ধিজাত জ্ঞান দিয়ে সেই পরিস্থিতির মোকাবেলা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় । এর জন্য প্রয়োজন বিশুদ্ধ শক্তিশালী অন্তরের । তোমার সাধনার অগ্রগতি ও অন্তরের স্বচ্ছতা সর্ম্পকে জানতে পেরে ভাবলাম----, সেখানে তোমার যাওয়া উচিত । সেখানে গেলে একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা লাভ হবে ।
সেখানে যেয়ে সুযোগ বুঝে রাণী মাতাকে Love you বলে দিবে । তারপর সকল পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য অন্তরের বুদবুদ হতে উৎসারিত জ্ঞান থেকে সাহায্য নেয়ার চেষ্টা করবে । এতে সফলতা বা বিফলতার তেমন কিছুই নাই । তবে তোমার কিছুটা হলেও জ্ঞান বাড়বে । যা পরে সাধনার জন্য কাজে লাগবে । আর মনে রেখ--, কোনো অবস্থাতেই রাণীমাতার সাথে বেশী অন্তরঙ্গ-ঘনিষ্ট হওয়া যাবে না ।---- এই কথাগুলো বলে গুরুরাজ আমাদেরকে বিদায় দিলেন ।

শীলা দেবী সহ তার বাসায় চলে এলাম । সে অভয় দিয়ে বললো--, সাধনার পথে তুমি অনেক দুর এগিয়ে গেছ , সামনে আরো যাবে । তখন কি আমার কথা মনে রাখবে ? আমি বললাম , তোমাকে কোনোদিনও ভুলবো না । তুমি আমার জীবন বদলে দিয়েছ । আমি সাধনা ছাড়তে পারি , কিন্তু তোমাকে ছাড়ব না । সে শুধু বলেছিল , ধ্যাৎ বোকা ।
শীলা দেবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসবো--, এমন সময় তার ছোট বোন লীলাবতী আমাকে একটা চিঠি দিল । আমি কিছুটা অবাক হলাম । তার ছোট বোনের দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনেকদিন থেকেই শীলা দেবী ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক ইঙ্গিত দিয়েছিল । যেন লীলাবতীর সাথে অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠ হয়ে তাকে সাধনার পথে নিয়ে আসি । কিন্তু আমি তেমন একটা আগ্রহ দেখাই নাই ।

ফিরে আসতে আসতে চিঠিটা পড়তে লাগলাম । প্রথমে প্রেম পত্রের মত মনে হলো । তারপর দেখি এটা একটা সতর্কতা মূলক উপদেশ পত্র ।
লীলাবতী লিখেছে------, ভাইয়া । বন্ধু-প্রিয়-আত্মীয় সহ আমার অনেক কাছের মানুষ থাকলেও আপনি আমার প্রানের মানুষ । আপুর সাথে আপনার ধ্যান ও সাধনা দেখে দেখে আমিও একাকী এলোমেলো ভাবে চেষ্টা করেছি । তেমন সফল হতে পারি নাই । রুপবতী উঠোনে যেন আপনি সফল হোন---, সেইজন্য এই পত্র দিলাম । আশা করি এর ইঙ্গিত গুলো আপনার কাজে লাগবে------,
(১) মহা-প্রলয়ের সময় ফেরেশতা ঈসরাফীল (আঃ) শিংগায় প্রথমে ধ্বংসের একটা ফুঁক দিবেন । অনেক কিছু ধ্বঃস হয়ে যাবে । এরপর সেগুলোকে পুনরায় সৃষ্টি করার জন্য শিংগায় সৃষ্টির আর একটা ফুঁক দিবেন । ধ্বংস আর সৃষ্টির এই দুই ফুঁকের ধরণ দুই রকম । এই দুই ফুঁকের বিরাট ব্যবধানের মাঝামাঝি সময়ে গর্ব আর আক্রোসের সর্বোচ্চ রুপ ধারণ করে স্রষ্টা একটা ভাষণ দিবেন ।-- এর ইঙ্গিত ঐশী কিতাব গুলোতে আছে ।
(২) নিজ স্বত্বার সৃষ্টি উপাদানের বড়াই করে ইবলীস আদম (আঃ) কে সেজদা করে নি । কর্ম , জ্ঞান আর বংশীয় মর্যাদার অহমিকা এই ক্ষেত্রে তার কোনো কাজেই আসলো না । সে লানতের বেরী পরে চির অভিশপ্ত হয়ে গেল ।
(৩) লোকদেরকে যুদ্ধে যেতে বলায় তারা বলল----, তুমি আর তোমার আল্লাহ যেয়ে যুদ্ধ কর । নবী সোলায়মান (আঃ) এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গর্বের সাথে বলেছিলেন , আমার একশত বিবির সাথে মিলিত হবো । একশত সন্তান হবে । তারপর একশত ঘোরসওয়ার নিয়ে যুদ্ধে যাব । ক্ষনিকের উত্তেজনাময় তার এই গর্ব-- , স্রষ্টার উপর ভরসা ও সাহায্যের মুখাপেক্ষি ছিল না । মাত্র একজন বিবি বাদে আর কোনো বিবিরই গর্ভ সঞ্চার হলো না । সেই বিবিও আবার পঙ্গু বাচ্চা প্রসব করল । একেবারেই বিকলাঙ্গ । এতদিন পরে নবী তার চাওয়ার সাথে স্রষ্টার চাওয়ার অমিলটা বুঝতে পারলেন । আর ইনশা-আল্লাহ ( আল্লাহ চাহেতো ) না বলার ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়ে নিলেন ।
(৪) রাবেয়া বসরী আর হাসান বসরী একদিন সমুদ্র সৈকতে হাটছিলেন । নামাজের সময় হলো । হাসান বসরী জায়নামাজ পানিতে বিছিয়ে দিলেন । তারপর হালকা গর্বের সাথে রাবেয়া বসরীকে তার সাথে নামাজ পড়ার আহবান জানালেন । রাবেয়া বসরী একটা মুচকী হাসি দিলেন । তারপর বাতাসে জায়নামাজ উড়িয়ে দিয়ে পাল্টা আহবান জানালেন । হাসান বসরীর সাধনা অত উঁচু মানের ছিল না । সে নিরুপায় । তার গর্ব খর্ব হল । ভিষন লজ্জা পেল । রাবেয়া বসরী বললেন ---, মাটিতে ব্যবস্থা থাকতে পানিতে ও বাতাসে জায়নামাজ বিছাবার কোনই প্রয়োজন নাই । খামাখা এত বাহাদুরী বাদ দিয়ে এসো আমরা মাটিতেই নামাজ পড়ে নেই ।
আপনাকে ইশারা-ইঙ্গিত দেবার আর কি-ই বা আছে ? তবে , আর একটি কথা---, সেখানে যাওয়ার আগে দোয়া পড়ে শরীর বন্ধ করে নিবেন ।"
ইতি------
লাল দোপাট্টা ।

অনেক দিন আগে কয়েকজন বন্ধু সহ যাচ্ছিলাম পাশের গ্রামে । রাস্তার সাথে সুন্দর একটি বাড়ী । বারান্দায় জটলা পাঁকানো কয়েকজন মেয়ের মধ্য থেকে একজন আমাকে ছালাস দিল । বাকীরা হেসে উঠল । পিছু ফিরে ছালামের উত্তর শেষ না করতেই মেয়েটি বলল---, ভাইয়া , এটা কিন্তু সত্যিকারের ছালাম । আবারো অট্রহাসি । আধো আধো বিকশিত কিশোরী বধূর মত লাল স্কার্ট পরা লীলাবতীকে অপরুপ সুন্দর লাগছিল । কিছুটা বিব্রত হয়ে-----, হাওয়া মে উড়াতা , লাল দোপাট্টা--- মল মল মল--- কা----- বলে চলে এসেছিলাম । কিন্তু লীলাবতী এটাকে যে মনের মধ্যে গেঁথে নিয়ে এত দিন ধরে লালন করবে ,-- তা বুঝে আসে নি । এখন বুঝলাম আমারও দাম আছে । প্রেম-বিরহের দোলায় বুকের ভিতরটা হু-হু করে উঠল ।

রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর শুরু হওয়া মাত্র রুপবতী উঠোনে আলোর ঝিলিক চমকাতে লাগল । চারিদিকে কোলাহল বেড়ে গেল । রাণীমাতা অপরুপ সাজে অপূর্ব মোহনীয় ভঙ্গিমায় চলে এলো । হূদয়ে হূদয়ে আনন্দ-উল্লাসের হিল্লোল বয়ে গেল । উঠোনের মাঝ বরাবর এসে রাণীমাতা ওড়নাটা খুলে উপরের দিকে উড়িয়ে দিল । সাপের মত আঁকাবাঁকা ঢেউ তুলে নিচে নামা মাত্র ওড়নাটা ধরে এক হাতে পেঁচিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে গান গাইল-----,
" রং বেরং -এর ঢেউ তোলে / আজ আমার ওড়নার বদলে / প্রিয় জনের মন পাওয়া যায় / এই ওড়নার বদলে // ----- এরপর ওড়নাটাকে গলায় পেঁচিয়ে সামনের দিকে মাঝ বরাবর ঝুলিয়ে দিয়ে অকল্পনীয় অসাধারণ একটা নাচ নচতে লাগল । অনেকটা সাপ আর বানর নাচের আদলে খুবই ঝাঁকানাকা । ভক্তদের করতালি আর উল্লাস রাণীমাতাকে যেন আরো উসকে দিল ।

আমি অবাক হলাম । ভাবতে লাগলাম---, কোনো মানুষের পক্ষে কি এরকম 'নাচ' নাচা সম্ভব ! রাণীমাতা কি আসলেই মানুষ ? না-কি মানুষের মত অন্য কিছু ? যদি সাপ , জ্বীন আর মানুষের উপাদানে কোনো মায়াবিনী হয়---, তাহলে কি হবে ?
যদি তার মধ্যে সর্পরাণীর বৈশিষ্ট বেশী হয় , তাহলে তার চুমুতে মৃত্যু না হলেও বেহুশ হয়ে পরে থাকতে হবে -- , এতে কোনো সন্দেহ নাই । আর যদি জ্বীন-পরী হয় , তাহলে তার আলিঙ্গনে ঝলসে না গেলেও তীব্র উঞ্চতা সহ্য করা কঠিন হয়ে যাবে ।

লীলাবতীর কথা মনে পরে গেল । শরীর বন্ধ করতে হবে । এই সংকটকালে বুঝতে পারলাম ধর্মীয় জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা । আমার তেমন কোনো জানা নেই । কুরানের গুটিকয়েক শব্দ আর বাক্য কোনরকমে শুদ্ধ-অশুদ্ধ ভাবে পড়ে ইশারা-ইঙ্গিতে ফুঁক দিয়ে শরীর বন্ধ করে নিলাম ।

ঝলকে-পুলকে , চমকে চমকে রাঙাইয়া রজনীর প্রান----, রাণীমাতা নাচ শেষ করলেন । রঙিন পানির চুমুকে চুমুকে অনেকে বেতাল হয়ে গেল ।
এরপর শুভেচ্ছা বিনিময় পর্বে ,----- লাল গোলাপের মধু উপহার সহ হূদয়ের নিবেদনে কত-না কথার ফুলঝুড়ি । রাণীমাতার শুভ নজর পাবার জন্য দেহ-মনের সে কি অর্পূব নিবেদন ।

রাণীমাতা কাছাকাছি এসে গেছে । কুশল জিজ্ঞাসা ও শুভেচ্ছা বিনিময় হবে । আমিতো সঙ্গে কিছু নিয়ে আসি নাই । ভাবলাম সুন্দর একটা হাসি উপহার দিব । কিন্তু অন্তর প্রস্তুত ছিল না । সতর্ক সৌজন্যতার সাথে রাণীমাতাকে মরিয়ম ফুলের শূভেচ্ছা জানালাম । আর বললাম ,--- এ ফুলের অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো , --- অনেক দিনের শুকনো ফুল পানিতে ফেললে উহা ধীরে ধীরে সতেজ হয়ে উঠে । এ ফুলের মতই রাণীমাতা যেন আজীবন সতেজ ও সুন্দর থাকে ।--- এ কথাটা রাণীমাতার খুবই পছন্দ হলো । সে আমাকে হালকা হাসি সহ ধন্যবাদ জানাল । আর সুযোগ বুঝে আমিও তাকে Love you বলে দিলাম । এতে বিরক্ত হয়ে বাঁকা চোখে একটু তাকিয়ে নিয়ে রাণীমাতা সামনের দিকে এগিয়ে গেল ।

শুভেচ্ছা পর্ব শেষে ভোজন পর্ব শুরু হলো । ফলমুল সহ অনেক ধরনের খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে । রাণীমাতা খুবই আন্তরিকতার সাথে তদারকী করছে । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে হবে । এভাবে খাবার পরিবেশনের ধরন দেখে মনে হলো---, এর মধ্যে কোনো রহস্য আছে । বৈজ্ঞানিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে খাদ্য গ্রহনের নিয়ম-নীতি মনে করার চেষ্টা করলাম । পারলাম না । খনার একটা বচন মনে পরে গেল---, " ফল খেয়ে জল খাওয়া যায় না " । খাওয়া শেষ করে জল খেয়ে তারপর ফল খাবার সিদ্ধান্ত নিলাম । সবাই সবার মত খেতে লাগল । খাওয়া প্রায় শেষ । রাণীমাতা সামনে এসে স্ব-হাস্য বদনে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । সে আমার সাথে ফলের একটা টুকরো নিয়ে চিবাতে লাগল । হূদয়ের নিবেদনে আমি একটা সুন্দর হাসি উপহার দিলাম । রাণীমাতা বলল----, " সবাই খাবার খেলো , কিন্তু কেউ কোনো নিয়ম মানল না । তোমার একটা ব্যপার আমাকে ভাল লাগল । আমি অবাক হলাম । ভাবলাম---, অতি উঁচু সংস্কৃতির এরুপ সভ্যতা তুমি শিখলে কি করে " ?
আমাকে যে রাণীমাতার মনে ধরেছে---, এটা বুঝতে পেরে মনের আনন্দ মনেই লুকালাম ।

রাত পোহাবার আর বেশী দেরী নাই । আহারের পর্ব শেষ । এখন মূল পর্ব শুরু হবে । এটা প্রশ্ন উত্তর পর্ব বা জ্ঞানের পরীক্ষা পর্ব নামেই বেশী পরিচিত । রাণীমাতা আসনে বসে গেছে । এখন প্রশ্ন করবে । আর সবাই উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবে । রাণীমাতা প্রতি বছর এরুপ একই প্রশ্ন করে থাকে । কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো উত্তরই তার মন মত হয় নাই ।

অনন্ত তৃঞ্চা নিয়ে সবাই চেয়ে আছে রাণীমাতার মুখ পানে । রাণীমাতা তার তর্জনী আঙ্গুল উপরে তুলে ধরলো ।-- এটাই তার প্রথম প্রশ্ন । সবাই একদম চুপ । কারো কোনো কথা নেই ।
আমি খুব অবাক হলাম । ভাবলাম--, এটা আবার কেমন প্রশ্ন ? ভেবে ঠিক করলাম--, ইঙ্গিতময় এই প্রশ্নের উত্তর ইঙ্গিতেই দেয়া উচিত ।
আমার মনে হলো--, রাণীমাতা এক আঙ্গুল উঁচিয়ে হয়তো বলতে চাচ্ছে ---, " এখানে কেউ কি আছে , যে আমার দুঃখ-কষ্ট একটু কমিয়ে দিতে পারে ? আমাকে প্রাণ ভরে একবার Love you বলে একদানা ভালোবাসা উপহার দিতে পারে ?"
আমি ভাবলাম----, অহংকারী হলেও রাণীমাতার ব্যবহার অনেকটা ভাল । এত বড় আয়োজন করল । কত কিছু খাওয়ালো ! তাছাড়া শুভেচ্ছা পর্বে তাকে কোনো উপহারও দিতে পারি নাই । এখন শুধু শুধু একদানা ভালবাসা দেয়া কি ঠিক হবে ? তার তো একটা সম্মান আছে । যদি সম্মান কম হয় ? ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম---, তাকে দুই বার Love you বলে দিয়ে দুই দানা ভালবাসাই উপহার দিব । তার প্রশ্নের উত্তরে এটা বুঝাবার জন্য দুই আঙ্গুল উপরে তুলে ধরলাম ।
মনে হলো---, উত্তরটা রাণীমাতার কিছুটা পছন্দ হয়েছে ।

রাণীমাতা এবার তিন আঙ্গুল উপরে তুলে ধরলো ।-- এটা তার শেষ প্রশ্ন । এতে আমার মাথা ঘুরে গেল । বুদ্ধি অবশ হয়ে এলো । ভাবতে লাগলাম----, রাণীমাতার লোভ আর অহংকার হয়তো বেড়ে যাচ্ছে । তিন আঙ্গুল উঁচিয়ে এখন আবার তিনদানা ভালবাসা পেতে চাচ্ছে । এরপর আরো চাইতে পারে ।
আমার কেনো জানি মনে হলো-----, এটা রাণীমাতার একটা শয়তানী হতে পারে । সে ছলনা করে জিততে চায় । সে ছেলেদের মন আর আবেগ নিয়ে মশকরা করতে চায় ।
আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল । দানা-দানা তো দুরের কথা----, সামান্য একটু ভালবাসা দিতেও মন চাইল না । তাকে আর কিছুই দিব না , ঘেচ্চু দিব ।--এটা বুঝাবার জন্য শেষ প্রশ্নের উত্তরে বুড়া আঙ্গুল উপরে তুলে ধরলাম ।

অবাক কান্ড ঘটে গেল । রাণীমাতা এক লাফে আসন ছেড়ে উঠলেন । আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন । চিৎকার করে বলতে লাগলেন--, " এতদিন পরে আমি আমার জ্ঞানী মানুষ , মনের মানুষ পেয়ে গেছি " । কিছু বুঝে উঠার আগেই---, সবাই আমাকে নিয়ে নাচানাচি, মাতামাতি শুরূ করে দিলো । চারিদিকে আনন্দ, উল্লাস আর করতালি । এরই মধ্যে রাণীমাতার আসনের পাশে আমার বসার ব্যবস্থা হলো ।

রাণীমাতা উঠে দাঁড়ালেন । সবাই চুপ হলো । রাণীমাতা বলতে লাগলেন----, আমি যখন এক আঙ্গুল উঁচিয়ে প্রথম প্রশ্ন করলাম--, " স্রষ্টা এক " -- তোমরা কি এটা বিশ্বাস করো ? সে দুই আঙ্গুল উঁচিয়ে উত্তর দিয়েছিল---, স্রষ্টার সাথে নবীও আছে । আমি যখন তিন আঙ্গুল উঁচিয়ে শেষ প্রশ্ন করলাম,---- " স্রষ্টা তিন " -- এটা কি তোমরা বিশ্বাস করো ? সে বুড়া আঙ্গুল উঁচিয়ে দৃঢ়তার সাথে বলেছিল,--- না, স্রষ্টা একজন ।
আর আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে ধন্য । আজ আমার জীবনের মহা আনন্দের দিন । তোমরা আনন্দ করো । ব্যথা ভুলো । সবাইকে অভিনন্দন । কেউ না খেয়ে যাবে না । রাণীমাতার কথা শেষ হতে না হতেই সবাই শরাব পানের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠল ।

রাণীমাতা আমাকে অন্দর মহলে নিয়ে গেল । তার দেহ-পল্লবে আনন্দ-খুশীর দোলা । ঠোঁটে হাসির ঝিলিক । দেহ-মনের ভক্তি নিবেদনে সে আমাকে অনেক আপন করে নিল । অতি অল্প সময়ে রাণীমাতা অন্তরঙ্গ হয়ে বলল---, " তুমি কিভাবে এত সহজে এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিয়ে দিলে ?
আমি মিথ্যার আশ্রয় না নিয়ে সত্য কথাটাই বলে দিলাম । সঙ্গে সঙ্গে রাণীমাতার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল । শরীরে মরুভূমির শুষ্কতা নেমে এলো । আমাকে ধমক দিয়ে বলল---, চুপ করো । এই কথা কাউকে বলবে না । আমার মান-সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছ ।
তখনই উত্তরের ব্যাখ্যা জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল । তা-না করে বড়ই ভুল করেছি । ক্ষোভে, দুঃখে রাণীমাতা সাপের মত ফোঁস ফোঁস করতে লাগল ।
রাগত স্বরে বলল---, যা হবার, তা তো হয়ে গেছে । এখন কি করবে, বলো ?
আমি বললাম : বলাবলির আর কি আছে । তোমার জন্য দোয়া করব । যাতে তোমার মনোকষ্ট দুর হয় । আর আশা পূরন হয় ।
রাণীমাতা বলল : ঠিক আছে ,--- তাই করো । দোয়া দিয়ে চলে যাও ।
আমি বললাম : কিন্তু তোমাকে যে ভাল হতে হবে ।
রাণীমাতা বলল : তাহলে , আমি কি খারাপ হয়ে গেছি না-কি ?
আমি বললাম : না । তুমি ভালো । তবে আরো ভাল হতে হবে । তা-না হলে দোয়ার মালিকের কাছে ফলচে পরতে হবে , বিব্রত হতে হবে ।
রাণীমাতা বলল : তোমাকে ভাল-জ্ঞানী-সৎ মনে করেছিলাম । তোমাকে মনের মানুষ , প্রানের মানুষ ভাবতে শুরু করেছিলাম । কিন্তু তুমি মিথ্যা দিয়ে সব তছনছ করে দিলে । তোমার প্রতিটি কথায় প্রতারণার ছোঁয়া । তোমাকে বিশ্বাস করে বড়ই কুর্কম করেছি । ভাবতে পারছি না ---, আমি এখন কি করব ?

আমি খুব নরম সুরে বললাম , ------
" রাণীমাতা " ,
তীক্ষ্ম সুক্ষ্ম বুদ্ধি দিয়ে বলেছ তুমি কত কথা ,
তোর মত মেয়ে উল্টো করে বুঝলো কিনা মোর ভাষা !
ভ্রান্তি নাশী শান্তি লাভের ক্ষনিক আশা রয় যদি তোর
মিথ্যে ভয়ের ভয় পেয়ো না, নিত্য ভয়ের কাটুক ঘোর ।
জ্ঞান পিপাসীর জ্ঞানের কথা , ওলট-পালট ধোঁয়ায় ভরা
ছড়িয়ে পরুক তোমার তরে , প্রেম-স্নেহ-অশেষ আশীষ---
জ্ঞানীর তরে অমৃত তা , বোকার তরে উহাই বিষ ।।

এবার রাণীমাতা অনেকটা শান্ত হলো । তার অশ্রুসিক্ত নয়ন আর ব্যথায় ভরা বুক যেন দুমড়-মুচড়ে হাহাকার করে উঠল । কাঁন্না জড়িত কন্ঠে বলল---, তুমি যেয়ো না । কিছুটা সময় আমার পাশে থাকো । আমার ভাল লাগবে ।

আমি বললাম---, তুমি না বললেও আমি তোমার পাশে থাকতাম । এ অবস্থায় তোমাকে ছেড়ে যাওয়া উচিত হবে না । তুমি জ্ঞানী । আমি তোমার চেয়েও তোমার জ্ঞানকে বেশী ভালবাসি । জ্ঞানের সাধনা তোমাকে রাণীমাতা থেকে দেবীমাতার আসনে বসিয়ে দিবে । আর তখন হূদয়ের টবে ফুটন্ত গোলাপের ভালবাসা জানিয়ে তোমাকে বার বার Love yoy বলব । আর সেটা হবে সত্যিকারের Love you ।

এ রকম কথা শুনে রাণীমাতার অন্তর খুশীতে ভরে গেল । তার দু'চোখে জলের ধারা বহমান । তবুও Sorry বলে হাসতে লাগল---, " নির্মল হাসি " ।।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এফ, আই , জুয়েল # সালেহ মাহমুদ = সুন্দর মন্তব্য । অনেক ভালো । আগের পরের সংখ্যা গুলো পড়তে পারো । আমার লেখায় একটা মাদকতা থাকে--- যা পাঠককে কাছে টানে ।। আমার লেখা তোমার মুগ্ধতা আদায় করে নিতে পেরেছে -- এটাই বা কম কি ? = = তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ
সালেহ মাহমুদ এফ.আই.জুয়েল ভাই, সালাম রইল। আপনার গল্পটি পড়তে পড়তে আমার কেবলই লাইলী-মজনু কাব্যের কথা মনে পড়ছিল। আপনার গল্পে সুফীবাদের প্রাবল্য আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনার আর কোন লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়নি বলে আমার মুগ্ধতা ছাড়া আপনাকে আর দেয়ার মত কিছুই রইল না। ধন্যবাদ আপনাকে।
এফ, আই , জুয়েল # নিভৃতে স্বপ্নচারী (পিটল) = অনেক দিন পরে এলে--- ধন্যবাদ ।।
এফ, আই , জুয়েল # Pondit Mahi = সুন্দর মন্তব্য । তোকে ধন্যবাদ ।।
পন্ডিত মাহী কিছুটা রুপকথা, প্রেম, জীবন দর্শন... বেশ চমৎকৃত হলাম আপনার উপস্থাপনায়...
এফ, আই , জুয়েল # Khondaker Nahid Hossain = মন্তব্যে চিন্তার গভীরতা অনেক ভালো লাগলো । তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ।।
খন্দকার নাহিদ হোসেন লেখা ভাল লাগলো। তবে আপনার গল্প গুলোতে যুক্তি আর একটু পরিষ্কার করে চাই। অন্তত আত্নবিরোধ পর্যন্ত যুক্তি চলুক তারপর না হয় বিশ্বাসে যাবো।
এফ, আই , জুয়েল # খোরশেদুল আলম = ভাই ! ভাগ্য ভাল । বেলা শেষে দেখা হলো । আপনার মন্তব্য অনেক ভাল । আপনাকে ধন্যবাদ ।।
খোরশেদুল আলম অন্যরকম একটি গল্প মনেহল 'গর্বের মধু গড়মিল ' লেখকের উচ্চ চিন্তায় লেখনি যা শিক্ষমূলক।

১৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১১ গল্প/কবিতা: ৬২ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "স্থিতিশীলতা”
কবিতার বিষয় "স্থিতিশীলতা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪